অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

মধু কিনে ঠকছেন না তো!

0
.

মধু একটি সুপেয় ঔষধিগুণ সম্পন্ন তরল ভেষজ। এটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগ মুক্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই তরল পণ্যটি ভেজাল বা নকল করে দেদারছে বাজারে বিক্রি করছে অসাধু চক্র। ক্রেতারা এনিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও বছরের পর বছর নকল মধুই আসল মনে করে কিনছেন। ভেজাল মধুর বিষয়ে কেবল সাধারণ ক্রেতারাই নয়,উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও। চলতি বছরের মাঝামাঝি এক অনুষ্ঠানে মৌ গবেষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন,‘এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে, যেন খুব সহজেই ভোক্তারা ভেজাল মধু নির্ধারণ করতে পারেন।’

শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী,বর্তমানে দেশে বছরে মাত্র চার হাজার মেট্রিক টন মধু উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন মধু ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারতে ৫৫০ মেট্রিক টন ও জাপানে ৮০ মেট্রিক টন মধু রফতানি হয়েছে। বাকি মাত্র তিন হাজার মেট্রিক টন আসল মধু সারা দেশের মানুষ ব্যবহার করেছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সারা দেশে অন্তত চার হাজার মেট্রিক টনের বেশি পরিমাণ নকল মধু বেচা-কেনা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন এলাকার মধু ব্যবসায়ী সাইফুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে বর্তমানে চাষের আসল মধু আছে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু নকল মধু এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বড় বড় মধু ব্যবসায়ীরাও আসল মধুর সঙ্গে চিনির রস মিশিয়ে ভেজাল বা নকল মধু বিক্রি করছে।’

সুন্দরবন থেকে নিয়মিত মধু সংগ্রহ করেন সাইফুল্লাহ ও তার সঙ্গীরা। তিনি জানান, ‘মধুর রং, স্বাদ ও গন্ধ মৌমাছির সংগৃহীত মিষ্টি রসের ওপর নির্ভরশীল। এর প্রধান রাসায়নিক উপাদান ফ্রুক্টোজ এবং ডেক্সট্রোজ। এছাড়া, সুক্রোজ, প্রোটিন, পটাসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, লৌহ, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, ক্লোরিন, গন্ধক এবং ভিটামিন ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘কে’ ও ‘ই’ এতে উপস্থিত থাকে। এ কারণে খাঁটি মধু খেলে বহুমুখী উপকার পাওয়া যায়।’ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘খাঁটি মধু খাওয়ার পর অন্তত ১০০ ধরনের উপকার পাওয়া যাবে। কিন্তু সরাসরি বুঝা যাবে না। তবে রোগ ব্যাধি কমে যাবে। শরীরের সমস্যাগুলো দূর হয়ে যাবে। প্রতি দিন এক চামচ করে মধু খেলে শরীর সুস্থ হয়ে উঠবে।’

আসল মধু চেনার উপায় কী, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আসল মধু মুখে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গলার ভেতরে এক ধরনের ঝাঁজ লাগবে। খাঁটি মধু পানির মধ্যে ছেড়ে দিলে সহজে গলবে না।একদম পানির নীচে চলে যাবে। কিন্তু চিনি বা মিষ্টির সিরা থাকলে নীচে যাওয়ার আগেই গলে যাবে। এছাড়া, সিগারেটের ফুয়েল পেপারে আসল মধু মিশিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলে এটা পুরে ছাই হয়ে যাবে। কিন্তু পানি বা মিষ্টির রস থাকলে ওই পেপারে আগুন জ্বলবে না। আসল মধু ফ্রিজে রাখলে কখনও জমাট বাঁধবে না, ফ্রিজের তাপমাত্রা যত কমানো হোক না কেন। দুধে যেমন সর পড়ে আসল মধুতেও তেমনই সরের মতো আবরণ পড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের মধু ব্যবসায়ী আবদুস সবুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,

‘বাজারে যেসব মধু পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই ভেজাল।’ দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি মধু চাষ করছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘টানা ১০ বছরে যারাই মধু নিয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই প্রশ্ন করেছেন, মধু আসল না ভেজাল। আসল মধু আর নকল মধুর কৌতূহল এখনও আছে।’ তিনি বলেন, ‘পানি অথবা রস মিশ্রিত মধু চুলার ওপর রাখলে চর চর করবে। কিন্তু খাঁটি মধু স্বাভাবিক থাকবে।’ আসল মধু চেনার আরও কয়েকটি উপায় উল্লেখ করেন তিনি।

আসল মধুতে ফেনা হবে না, তবে দুধের মতো সর পড়তে পারে। সব সময় আসল মধু গাঢ় ও পুরু হয়ে থাকে। আসল মধুর স্বাভাবিক সুন্দর গন্ধ থাকে। আর নকল মধুর একটু টক গন্ধ থাকবে ও পাতলা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আরও কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে আসল মধু নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ আছে।’

মোমবাতি পরীক্ষা: একটি মোমবাতি নিন ও মোমবাতির সলতেকে ভালোভাবে মধুতে চুবিয়ে নিন। এবার আগুন দিয়ে জ্বালাবার চেষ্টা করুন। যদি জ্বলে ওঠে, তাহলে বুঝবেন যে মধু খাঁটি। আর যদি না জ্বলে ,বুঝবেন যে ওই মধুতে পানি মেশানো আছে, অর্থাৎ ভেজাল মধু।

কাপড় পরীক্ষা: এক টুকরো সাদা কাপড়ে মধু মাখান। আধ ঘণ্টা রাখুন।তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। যদি দাগ থেকে যায়, বুঝবেন এটি খাঁটি মধুটি নয়।

ফ্রিজিং পরীক্ষা: মধুকে ফ্রিজের মধ্যে রেখে দিন। খাঁটি মধু জমবে না।ভেজাল মধু পুরোপুরি না জমলেও জমাট তলানি পড়বে ।

আগুন পরীক্ষা: মধুতে আগুন না জ্বললে বুঝবেন যে, ওই মধু পুরোটাই নকল বা ভেজাল মধু। এতে প্রচুর পরিমাণে পানি আছে। ফলে আগুন জ্বলছে না। আর যদি আগুন জ্বলে ওঠে এবং একই সঙ্গে পটপট শব্দ হয়, তাহলে বুঝবেন যে এই মধু আসল। তবে এর সঙ্গে পানি মেশানো আছে। মধুর ভেতরে যত বেশি পানি থাকে,আগুন ধরালে শব্দও তত বেশি হয়ে থাকে।

এছাড়া, বেশ কিছুদিন ঘরে রেখে দিলে মধুতে চিনি জমতে পারে। মধু পাত্রসহ গরম পানিতে যদি কিছুক্ষণ রাখেন, তাহলে এই চিনি গলে গেলে মধু আবার স্বাভাবিক হয় আসবে। নকল মধুর ক্ষেত্রে এটা হবে না। খাঁটি মধুর চিনির দানা অনেক বড় বড় হয়ে থাকে। যা দেখলেই স্বাভাবিক চিনির দানার মতো লাগে না।

জানা গেছে, বাংলাদেশে মধু উৎপাদনের প্রধান এলাকা হচ্ছে সুন্দরবন। দেশে মোট মধুর শতকরা প্রায় ২০ ভাগ এখান থেকে আসে। এই মধু প্রধানত গরান বা গোলপাতা গাছের ফুল থেকে সংগৃহীত হয়। সুন্দরবনের আরেক মধু খালশি জাতের। বাংলাদেশে প্রধানত Apis dorsata ও Acerana indica প্রজাতির দুধরনের মৌমাছি থেকে মধু সংগৃহীত হয়। প্রথম প্রজাতির মৌমাছিরা পোষ মানে না।যদিও এরাই বাংলাদেশের বেশির ভাগ মধু উৎপাদন করে।আর দ্বিতীয় প্রজাতির মৌমাছিরা পোষ মানে। এরা ঘরে ও বনে মৌচাক বাঁধে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন,খুলনা, যশোর, বগুড়া, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা ও চট্টগ্রামে মৌমাছির চাষ ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে। সরিষা, আম এবং কুল গাছের ফুল থেকে চাষের মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। বুনো ও গৃহজাত মধু নারিকেল, পিঁয়াজ ও লিচু জাতের। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জুন, এ সময়ে মৌমাছির মধু সংগ্রহের মৌসুম। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মেসৈুমে সবচেয়ে বেশি মধু সংগ্রহ করা হয়।

মধুর কিছু গুণাগুণ
চায়ের সঙ্গে মধু ও আদার রস মিশিয়ে খেলে সর্দি ও শ্লেষা রোগের উপশম হয়। পানির সঙ্গে অল্প পরিমাণে মধু মিশিয়ে পান করলে পাকস্থলীর উপশম হয়। প্রতিদিন ভোরে দুই চা- চামচ মধু পানিতে মিশিয়ে একাধারে চার-পাঁচ মাস ধরে পান করলে চুলকানি, ব্রন,ফুসকরি প্রভৃতি ত্বকের রোগ একেবারে নির্মূল হয়ে যায়। এক কাপ দুধের সঙ্গে এক চা-চামচ মধু মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খেলে শক্তি বাড়ে।