অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

একজন পুলিশ অফিসারের ডায়রি..!

0
সালেহ ইমরান

ছবিতে আমার পাশে থাকা এই ব্যক্তি দুজন রংপুর জেলার তারাগঞ্জ থানার চিল্লাপাক গ্রামের বাসিন্দা। আজ (২৩/০৯/২০১৬, শুক্রবার) সকালে বাসী মুখে মেয়েকে খোঁজার জন্য ছেলেকে সাথে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েছেন এই মা আর ছেলে।

নিয়ম অনুযায়ী কেউ মিসিং হলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট থানায় যাওয়ার কথা। তা না করে উনারা তারাগঞ্জ থেকে সোজা চলে এসেছিলেন আমাদের অফিসে মানে পিবিআই, রংপুর অফিসে।

ছবি: সালেহ ইমরানের ফেসবুক ওয়াল থেকে

স্বভাবতই কৌতূহল জাগল থানায় না গিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের এই মা আর ছেলে কেন আমাদের অফিসে চলে আসলো তা জানার।

ছবিতে থাকা কলেজ পড়ুয়া ছেলেটি জানাল, কার কাছে যেন পিবিআই এর কথা শুনেছিল। পিবিআই কে নাকি খুব ভালো বলেছিল এবং মনে মনে বিশ্বাস ছিল পিবিআই এর কাছে গেলে তার বোনের সন্ধান পাওয়া যাবে, তাই সেই বিশ্বাস থেকেই কালক্ষেপণ না করে সাত সকালে বাসী মুখেই তার মাকে নিয়ে থানায় না গিয়ে তারাগঞ্জ থেকে সোজা রংপুর চলে এসেছে।

এমন বিশ্বাস নিয়ে যে মানুষটি এতো দূর থেকে আমাদের কাছে এসেছে তার যদি একটু উপকার না করতে পারি নিজেকে সত্যিই ছোট মনে হবে।

তাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাদের কথা গুলো শুনলাম। জানতে পারলাম, তারাগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী কবিতা (ছদ্ম নাম) গতকাল বৃহস্পতিবার (ইং ২২/০৯/২০১৬) কলেজে যাওয়ার কথা বলে আর বাসায় ফিরে আসে নি।

উনাদের কাছ থেকে কিছু নাম্বার এবং মেয়েটির এক ফ্রেন্ড সহ কয়কজনের সাথে ফোন দিয়ে কিছু তথ্য কালেক্ট করলাম। বেশ কিছু নাম্বারকে টার্গেট করে একটি নাম্বারের কথা বলার ধরন দেখে মোটামোটি নিশ্চিত হলাম যে ঐ লোকটি এই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ/পরোক্ষভাবে জড়িত।

পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স এর কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা চাইলাম। মেয়েলি ঘটনা থাকায় খুব দ্রুতই সাড়া পেলাম। সন্দেহভাজনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এটুকু বুঝতে পারলাম মেয়েটি রংপুরেই আছে।

screenshot_4
পুলিশ অফিসার সালেহ ইমরানের ফেসবুক পোস্ট।

আমি নিজে মেয়েটির প্রতিবেশী পরিচয় দিয়ে সন্দেহভাজনের সাথে প্রায় ১৫-২০ মিনিটের মত কথা বললাম। অত্যন্ত ভদ্র এবং বিনয়ের সাথে একজন মায়ের অসহায় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ছেলেটিকে বললাম, দেখো ভাই এই মা গতকাল থেকে কিচ্ছু খায় নি। আজ তোমার বোনের এরকম অবস্থা হলে কিরকম অবস্থা হতো একটু ভেবে দেখো।

কিন্তু কথায় কথায় বলে, চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী, ছেলেটির অবস্থা ছিল সেরকম।

কথার এক পর্যায়ে যখন দেখলাম কোনভাবেই ছেলের ধারে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না, শেষে শুধু একটি কথাই বললাম, গাধায় পানি খায় তবে ঘোলা করে। নিজেকে বেশী শেয়ানা মনে করলে কিন্তু লাইফটা থানা পুলিশ করতে করতে তেজপাতা হয়ে যাবে। এটা বলে ফোনটা রেখে দেই আর ঐ ভদ্র মহিলা আর ভাইটিকে আমার নাম্বার দিয়ে বলে দেই কোন টেনশন না করার জন্য। বলে দেই, দেখবেন আপনার মেয়ে আজ কালের মধ্যেই চলে আসবে। কোন তথ্য পেলে অবশ্যই যেন সাথে সাথে জানায় সেটাও বলে দেই।

এই বলে তাদের যখন বিদায় দেই তখন দুপুর প্রায় পৌনে একটা। সকাল থেকে তাদের সহ আমার পেটে এক ফোটা জলও পড়েনি তখনও।

তাদের বিদায় দেওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ফোন করে বলতেছে মেয়েটিকে নাকি পাওয়া গেছে। সে বাড়িতে যাচ্ছে। সেই নাম্বারের ব্যক্তির কাছ থেকে নাম পরিচয় জানতে চাওয়ার চেষ্টা করলেও পাওয়া যায়নি।

তখন ঘড়িতে প্রায় দুইটা। সাথে সাথে ভদ্র মহিলার সাথে থাকা মেয়েটির ভাই এর কাছে ফোন দিলাম। জানতে চাইলাম কোন আপডেট আছে কিনা। সে বলল আমার সাথে কথা বলে যাওয়ার পর আর কোন ফোন বা আপডেট পাওয়া যায়নি।

আমি তাদেরকে বাড়িতে খোজ নিতে বললাম এবং আবারো আশ্বস্ত করলাম আজকের মধ্যেই তার বোন বাড়ি চলে আসবে।

মিনিট বিশেক পরে মেয়েটির ভাই এর মোবাইল থেকে ফোন আসলো। তার বোনকে পাওয়া গেছে খুশির খবরটি জানালো। বললো তার বোন ফোন দিয়েছিল। তার সাথে কথা হয়েছে। সে রংপুরেই আছে। এবং বাড়িতে যাচ্ছে।

সৃষ্টিকর্তার কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম। মনের বিশ্বাস থেকে যে মানুষগুলো এতো দূর থেকে আমাদের কাছে সেবা পাবার জন্য আসছিল হয়তো কাকতালীয়ভাবে সব কিছু ব্যাটে বলে মিলে গেছে এই ভেবে একটু স্বস্তি লাগছিল।

বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, ছেলেটির ভাই এর সাথে সর্বশেষ কথা বলার প্রায় ৩০ মিনিট পর সেই মা আর ছেলে আবার আমাদের অফিসে হাজির। আসছেন আমার সাথে দেখা করার জন্য। আমি ঠিক তখনও বুঝতে পারিনি আমার জন্য এতো বড় একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।

অফিসে এসে ভদ্র মহিলা আমার মাথায় হাত রেখে বলতেছে, বাবা আমরা একেবারে গরীব মানুষ। সব মিলিয়ে তিন শতক জমি আর আমি নিজে সেলাই এর কাজ করে কোনরকমে সংসার চলছে। আমার মেয়েকে যে এতো তাড়াতাড়ি এভাবে ফিরে পাবো তা কল্পনাও করিনি। আমি আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনি। মাত্রই মসজিদ থেকে দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। বলতে বলতে যেন জড়িয়ে যাচ্ছিলো কথাগুলো!

ছোট্র চাকুরী জীবনে নানা অপ্রাপ্তি আর ব্যর্থতার মাঝে মহান সৃষ্টিকর্তা যখন এই অধমের মাধ্যমে কিছু অসহায় মানুষের একটু উপকার করার সুযোগ করে দেন আর সেই অসহায় মানুষগুলো যখন উপকার পেয়ে তাৎক্ষনিক এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ দিয়ে যায়, সেই মুহুর্তের কথা মনে হলে কেন জানি মনের অজান্তেই দু-চোখ ভারী হয়ে আসে।

আসলে সহজ সরল সাধারণ মানুষগুলোর খুব বেশী চাওয়া পাওয়া থাকেনা। ওদের সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলে তারা যে খুশিটুকু হয় এবং সৃষ্টি কর্তার কাছে মন থেকে দোয়া করে আমার মনে হয়না কোটি টাকা দিয়ে আপনি কাউকে এতোটা খুশি করতে এবং দোয়া নিতে পারবেন। আর যদি পারেনও সেটা খুবই সাময়িক।

প্রতিজ্ঞা করছি, যতদিন এই পেশায় আছি এবং যেখানেই আছি সেই জায়গাটিকে আলোকিত করে রাখার চেষ্টা করব,। চেষ্টা করব নিজের ক্ষুদ্র সামর্থের মধ্যে সাধারণ মানুষের উপকার করার ।

প্রত্যাশা থাকবে যেখানেই থাকি সেখানকার মানুষগুলো যেন এভাবেই তাদের বিপদের সময় অন্তত মনের জোর আর বিশ্বাস নিয়ে চলে আসেন। প্রত্যাশা, মানুষের দোয়া আর ভালোবাসা নিয়ে বাচার ।

লেখক: সাব ইন্সপেক্টর, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), রংপুর।