অনুসন্ধান - অন্বেষন - আবিষ্কার

অবৈধ টাকার খনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার!

0
.

অবৈধ লেনদেনের টাকার খনি আর দুর্নিতীর আখড়ায়পরিণত হয়েছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার। পাশপাশি বন্দি নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাজার মু্ল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী মূল্য দিয়ে কারাবন্দিকে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপণ্য কিনতে বাধ্য করে কারা কর্তৃপক্ষ। অখাদ্যকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করাচ্ছে বন্দিদেরকে।

অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধার নামে আদায় করা হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। কারাগারে অবৈধভাবে অর্থ প্রদানের কবল থেকে বাদ পড়ছেন না দরিদ্র, পঙ্গু, শিশু বৃদ্ধদের কেউই। কারাগারে প্রবেশ থেকে শুরু করে জামিনে বা মামলায় খালাস পেয়ে কারা ফটক দিয়ে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে অর্থ আদায় করা যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে।

শুক্রবার (২৮ অক্টোবর) বিকালে ভৈরবে রেল স্টেশনে ৩ কোটি টাকার এফডিআর এর কাগজপত্র দেড় কোটি টাকার ৩টি চেক ও নগদ সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা সহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় কারাগারের জেলার মোঃ সোহেল রানা বিশ্বাস পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর কারাগারের দুর্নির্তীর বিষয়টি আবারও আলোচিত হচ্ছে।

৩ কোটি সহ গ্রেফতার হওয়া জেলার নোহেল রানা বিশ্বাস।

জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দিরা জানান, কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় কয়েদিরা (দীর্ঘ মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীরা) বন্দিদের কাছ থেকে এককালিন ও মাসিক হারে চাঁদা করতেন। নির্দিষ্ট সময়ের (সাজা কয়েদিদের বেঁধেদেয়া সময়ে) মধ্যে চাঁদা দিতে দেরি হলেই শারীরিক ভাবে নির্যাতনের শিকার হন তারা। শুধু তাই নয় কারাগারে প্রথম প্রবেশের দিন থেকে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি লাভের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। টাকা দিতে অস্বীকার করলে ক্রস ফায়ারের হুমকি প্রদান করা হয়। গত বছর এ ধরনের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত আবেদনও করেছেন জামিনে মুক্তিপাওয়া কয়েকজন আসামী।

রাজনৈতিক মামলায় সাড়ে ৫ মাস কারা ভেগে সম্প্রতি মুক্তিপাওয়া পতেঙ্গার পারভেজ আলম বলেন, আদালতের মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে কারাগারে নেয়া হলেই প্রথমে কারাগারের আমদানী নামক স্থানে রাখে। এখানে প্রতিজন বন্দিকে পারিবারিক অবস্থা বুঝে কয়েদিরা কিনে নেন। ধনি ও মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনকে টাকার অংক বুঝে রাখা হয় কারা হাসপাতাল অথবা পদ্মা নামক কথিত হাসপাতালে। কথিত পদ্মা নামক হাসপাতালে থাকতে হলে গুণতে হয় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর সরকারি হাসপাতালে থাকতে হলে এক একজন বন্দি গুণতে হয় ১২ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

দরিদ্র ও টাকা দিতে অপারগ বন্দিদের রাখা হয় গণরুমে। যেখানে একজনের স্থানে রাখা হয় ৮ থেকে ১০জনকে।

.

অভিযোগ রয়েছে, কারাগারের দুই হাসপাতালে বন্দিদের কাছ থেকে এ টাকা আদায় করেন চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের কয়েদি কিবরিয়া, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার কয়েদি দিদারুল আলম প্রকাশ বিডিআর দিদার (কয়েদি নম্বর-২১১০/এ), চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান এলাকার শহিদুল হকের ছেলে ইয়াছিন প্রকাশ মাওলানা ইয়াছিন, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মৃত আনোয়ারের ছেলে নাসির প্রকাশ বিডিআর নাসির, ফেনীর ফরহাদ প্রকাশ ডাক্তার মোস্তাফিজের পোষ্যপুত্র ফরহাদ।

জামিনে কারামুক্ত বন্দিরা বলেন, এরা চারজনই কারাগার সরকারি হাসপাতাল ও কথিত পদ্মা হাসপাতালে থাকা বন্দিদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে কারা চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমানের হাতে পৌছে দেন। এছাড়া কারাগারের বাহিরে চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রীও বন্দিদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কারাগারে মোবাইল করে সুবিধা প্রদানের জন্য বলে দেন। এর বিনিময়ে কারাগারে যৎ সামান্য সুযোগ-সুবিধা পান বন্দিরা।

কারাগার সূত্রে জানাগেছে, চট্টগ্রাম কারাগারের ১১৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে কারা হাসপাতাল, কথিত পদ্মা- ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া বাকী ওয়ার্ডের দায়িত্বে রয়েছে সুবেদার আজম ও ফয়েজ। এরা এক একটি ওয়ার্ড কারা অভ্যন্তরে কয়েদিদের কাছে একেকটি ওয়ার্ড দুই মাসের জন্য বিক্রি করেন ৮হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে।

কারাগারের অভ্যন্তরে অসুস্থ বন্দিদের চিকিৎসা করার নিয়ম থাকলেও তা শুধু কাগজে কলমে। কারাগারের চিকিৎসক ও র্নিদিষ্ট চার কেয়দির বাণিজ্যের কারণে কোন অসুস্থ বন্দি কারা হাসপাতালের বেডে স্থান পান না। কোন বন্দি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সিটের নীচে খালি ফ্লোরের মধ্যে রাখা হয়। নচেৎ বন্দিদের গণরুমেই তার স্থান। কারা হাসপাতালের বেডে চিহ্নিত দাগী সন্ত্রাসী, রাজনৈতি নেতা-কর্মী, স্বর্ণ-চোরাচালানী, ইয়াবা ব্যবসায়ী বা সচ্চল পরিবারের বন্দিরাই নির্দিষ্ট ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে থাকছেন। ডি.আই.জি বা সিভিল সার্জন কোনো সময় কারাগার পরিদর্শনে যাওয়ার আগেই সংবাদ কারাগারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কানে পৌছে যায়। আর এই সংবাদ পৌছার সাথে সাথে পাল্টে যায় কারা হাসপাতাল সহ কারা অভ্যন্তরের সকল দৃশ্য।

কারাগার সূত্রে জানাগেছে, কারাগারের মধ্যে পদ্মা নামক আরও একটি হাসপাতাল তৈরি করেছেন কারা পরিদর্শক, কারা চিকিৎসক, কার উপ-পরিদর্শক ও কয়েদিদের (নির্দিষ্ট কয়েদি) একটি সিন্ডিকেট। তারা নির্দিষ্ট তিনটি ওয়ার্ডকে কথিত হাসপাতাল বানিয়ে অর্থের বিনিময়ে নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। এর নাম দেয়া হয়েছে, পদ্মা-১, পদ্মা-২ ও পদ্মা-৩।

কারাগারে অর্থ আদায়ে পিসি কার্ড:
কারাগারে ঘুষ আদায়ের সুবিধার্থে বাহির থেকে কারারক্ষি প্রকাশ মিয়া সাবদের মাধ্যমে কারাগারে টাকা পাঠানো হয়। কারাগারে টাকা পৌছে দেয়ার বিনিময়ে হাজারে ৫০ থেকে ১০০ টাকা কমিশন আদায় করছে তারা। অনেক সময় হাজারে ২০০ থেকে ৩০০ টাকাও নিয়ে নেয়।

কর্ণফুলী ক্যান্টিন:

কারা রক্ষিদের পরিচালনায় কারা অভ্যন্তরে কর্ণফুলী সেলের সামনে একটি ক্যান্টিন রয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে কর্ণফলী ক্যান্টিন। এই ক্যান্টিনে সব ধরনের খাবার বিক্রি করা হয়। ক্যান্টিনটি পরিচালনা করেন কারারক্ষি আইয়ুব। একজন সরকারী কর্মচারী হয়েও শুধুমাত্র ক্যান্টিন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় এই আয়ুব নামক কারারক্ষিকে। আয়ুব নিজেই স্বীকার করেন, ক্যান্টিন পরিচালনার বিনিময়ে কারা পরিদর্শককে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা প্রদান করতে হয়। যার কারণে যে কোন পণ্য বা খাবার তিন থেকে চারগুণ বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের কেন্দ্রিয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।  তবে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম কারাগারে আগের চেয়ে অনেক শৃঙ্খলা এসেছে।  পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে আরো কিছু সময় লাগবে। কারো বিরুদ্ধে কোন ধরণের অনিয়ম পাওয়া গেলে কারা আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়।

*নগদ ৪৪ লাখ ফেনসিডিল ও ৩ কোটি টাকার চেকসহ চট্টগ্রামের জেলার গ্রেফতার